
স্বাধীনতার মূল্যঃ ৩ লাখ নয় ৩০ লাখ
স্বাধীনতার মূল্যঃ ৩ লাখ নয় ৩০ লাখ
দাবি: স্বাধীনতার মূল্যঃ ৩ লাখ নয় ৩০ লাখ
স্বাধীনতার মূল্যঃ ৩ লাখ নয় ৩০ লাখ
মাহাথির আহমেদ তুষার
যুদ্ধ এবং গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। কিন্তু যখন এই বিতর্ক একটি জাতির আত্মপরিচয় এবং আত্মত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন তা কেবল পরিসংখ্যানের বিষয় থাকে না, বরং হয়ে ওঠে নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্বের অংশ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়েও এমন একটি বিতর্ক বহু বছর ধরে চলছে। একদল দাবি করে এই সংখ্যা ৩ লাখ, যেখানে অধিকাংশই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ৩০ লাখ। এই নিবন্ধে আমরা ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ, গবেষণা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র বিশ্লেষণ করে এই বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করব।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসব্যাপী চলা এই যুদ্ধে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে, তার ভয়াবহতা ছিল অভাবনীয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এই গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছে।
গণহত্যার পরিসংখ্যান: স্বাভাবিক হত্যা নয়
গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা গণনা স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা গণনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রখ্যাত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুডলফ জে. রুমেল (Rudolph J. Rummel) গণহত্যার পরিসংখ্যান গণনার একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তার রচিত "Estimating Democide: Methods and Procedures" শীর্ষক নিবন্ধে এই পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গণহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে তার রচিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো Statistics of Democide (1998)। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে "Statistics of Pakistan Democide, Estimates Calculation and Sources" শীর্ষক নিবন্ধে রুমেল তার আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসারে দেখিয়েছেন যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৩ হাজার (3,003,000) লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন [ Rummel, R.J. (1998). Statistics of Democide: Genocide and Mass Murder Since 1900. Charlottesville: University of Virginia, Center for National Security Law. (অষ্টম অধ্যায়: "Statistics of Pakistan Democide, Estimates Calculation and Sources")]।
এই পরিসংখ্যানগুলো শুধুমাত্র সামরিক সংঘর্ষে নিহতদের সংখ্যা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, অনাহার এবং রোগ-শোকে মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত হিসাব। এটি কোনো মনগড়া সংখ্যা নয়, বরং গবেষণালব্ধ একটি সত্য।
গণহত্যার পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু হত্যাকাণ্ডকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। যেমন:
চুকনগর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
পাহাড়তলী বধ্যভূমি: ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
গল্লামারী বধ্যভূমি: খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য গণহত্যার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এসব গণহত্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং রুডলফ রুমেলের মতো আন্তর্জাতিক গবেষকের বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, ৩০ লাখ শহীদের হিসাবটি কোনো গালগল্প নয়।
এছাড়াও, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার (UNHRC) এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ২৪ লক্ষের অধিক। চিত্র-১ লক্ষ করুন, ১৯৭১ এ এসে মৃত্যুর এ গ্রাফ যেন এক পর্বতের রূপ ধারণ করে। এটি রুমেলের দেওয়া পরিসংখ্যানের কাছাকাছি একটি সংখ্যা এবং ৩০ লাখের হিসাবের পক্ষে একটি শক্তিশালী সমর্থন।
!চিত্র-১ঃ Death rate, crude (per 1,000 people) - Bangladesh
এই সংখ্যাকে আরও শক্তিশালী সমর্থন দেয় বিশ্বব্যাংকের একটি গ্রাফ। বিশ্বব্যাংকের ডেটাবেইজে প্রকাশিত 'মৃত্যু হার, ক্রুড (প্রতি ১,০০০ জনে)' গ্রাফটিতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মৃত্যু হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি হাজারে ৪১ জনে পৌঁছেছিল। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে এই হার ছিল ২০-এর নিচে। [ World Population Prospects, United Nations ( UN ), publisher: UN Population Division; Statistical databases and publications from national statistical offices, National statistical offices; Demographic Statistics, Eurostat ( ESTAT ); Population and Vital Statistics Report ( various years ), United Nations ( UN ), publisher: UN Statistical Division https://tinyurl.com/2we6bjxa]
যদি সেই সময়ে বাংলাদেশের আনুমানিক জনসংখ্যা ৮ কোটি ধরা হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু এক বছরেই মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ লক্ষ ৮০ হাজার (৮ কোটি x ৪১ / ১,০০০)।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিকতা: এক নীরব সাক্ষ্য
অন্যদিকে গণহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে যখন বিতর্ক ওঠে, তখন শুধু মৃতের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করলে চলে না, বরং সে সময়ের জনমিতিক উপাত্ত (demographic data) বিশ্লেষণ করাও জরুরি। ১৯৫০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পর্যবেক্ষণ করলে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।
- ১৯৫০-৫৫ সালে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৬%।
- ১৯৫৫-৬০ সালে তা সামান্য বেড়ে হয় ১৫.৩%।
- ১৯৬০-৬৫ সালে তা ১৫.৩%।
কিন্তু ১৯৭১ সালের পর, অর্থাৎ ১৯৭০-৭৫ সালের সময়কালে, এই হার হঠাৎ করেই কমে মাত্র ৫.৫% হয়ে যায়। পরের পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ১৯৭৫-৮০ সালে, তা আবার প্রায় স্বাভাবিক হয়ে ১৪.২% এ ফিরে আসে।
জনমিতির এই অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, ১৯৭১ সালের আশেপাশে কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল, যা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক গতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে।
চিত্র-২ এ থাকা গ্রাফটি দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। উপরে "Time Series Plot of Population of Bangladesh" নামের গ্রাফটিতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির রেখাটি বেশ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর, ১৯৭০-৭৫ সালের ডেটা পয়েন্টটিতে রেখাটি হঠাৎ করে নিচের দিকে নেমে এসেছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিকতাকে নির্দেশ করে।
যদি ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার বজায় থাকত, তাহলে আমাদের জনসংখ্যা যতটা বাড়ার কথা ছিল, তার চেয়ে প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষ কম ছিল। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, "বিহারি হত্যাকাণ্ড" এবং তৎকালীন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মতো অন্যান্য কারণগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় হিসাব করলেও, এটি পরিষ্কার যে মুক্তিযুদ্ধের কারণেই এই বিশাল সংখ্যক মানুষের ঘাটতি হয়েছে। যেকোনো যুক্তিসঙ্গত উৎস থেকে অন্যান্য প্যারামিটারগুলোর সর্বোচ্চ মান বাদ দিলেও, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের চেয়ে অনেক বেশি হবে। এই গ্রাফ এবং জনমিতিক উপাত্তগুলো ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাকে আরও জোরালোভাবে সমর্থন করে।
শেখ মুজিব কী ৩ লক্ষ কে ৩ মিলিয়ন বলেছিলেন?
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তার দেওয়া প্রথম ভাষণেই তিনি ৩০ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ করেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরকারি ও জাতীয়ভাবে স্বীকৃত সংখ্যা। কিন্তু এদেশের বিশেষ একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে। তাদের মূল দাবি, বঙ্গবন্ধু ভুলবশত ৩ লাখের পরিবর্তে ৩০ লাখ বলে ফেলেছেন। তাদের এই দাবিটি ভিত্তিহীন এবং ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারির অনেক আগেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। চলুন দেখি, শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকাকালীন সময়েই দেশি-বিদেশি পত্রিকা গুলো তে একাত্তোরের গণহত্যা নিয়ে কী কী খবর এসেছিলো।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের দিন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুল তার 'চরমপত্র' অনুষ্ঠানে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা বলেছিলেন। এটি ছিল প্রথম দিককার একটি প্রকাশ যা বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার আগেই এই সংখ্যাকে তুলে ধরে।
এর ছয় দিন পর, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, "হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু'শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।" এটিও প্রমাণ করে যে, এই সংখ্যাটি তখন থেকেই জনসমক্ষে ছিল। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন:
- ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২: তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা "প্রাভদা" (Pravda) ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি একটি সংবাদ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল "Over 30 lakh killed by Pak forces"
- ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২: মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, "Over 30 lakh persons were killed throughout Bangladesh by the Pakistani occupation forces during the last nine months"।
- ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২: দৈনিক অবজারভার পত্রিকার শিরোনাম ছিল "Pak Army Killed over 30 Lakh people"।
- ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২: দৈনিক বাংলা পত্রিকায় 'জল্লাদের বিচার করতে হবে' শিরোনামের নিবন্ধে ৩০ লাখ শহীদের কথা লেখা হয়।
!চিত্র-৩ঃ রাশিয়ার 'প্রাভদা' তাদের পত্রিকায় ৩০ লক্ষ শহীদের কথা প্রকাশ করে।
তথ্য প্রমাণে এটুকু তো পরিষ্কার যে, তিরিশ লক্ষ শহীদ কোনো স্বপ্নে পাওয়া কিংবা কারো ভুল উচ্চারণের ফল নয় বরং এটি একটি বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান। সবচেয়ে বড় কথা, শেখ মুজিবুর রহমান ৩ লক্ষ আর ৩ মিলিয়নের পার্থক্য জানতেন কী জানতেন না, সে তর্ক অর্থহীন। সামনে আমরা এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে যাচ্ছি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা ও নথিতে ৩০ লক্ষ শহীদ
আমাদের এই নিবন্ধের এই অংশে, আমরা কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা, থিসিস, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং ডিকশনারির দিকে দৃষ্টিপাত করে ১৯৭১ সালের গণহত্যার ভয়াবহতা ও শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রচলিত তথ্যপ্রমাণগুলো আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছি। গণহত্যার পরিসংখ্যান নিয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেন, তাদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন নথি ও গবেষণা এক অকাট্য প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস-এর ডিক্লারেশনে বলা হয়েছে, "মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যায় স্বল্পতম সময়ে সংখ্যার দিকে সর্ববৃহৎ।" এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে, যা গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্বোচ্চ নিধনের হার। ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৬০ দিনে এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। এই হিসাব অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা সর্বনিম্ন ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩১ লক্ষ ২০ হাজারের মধ্যে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার ১০ বছর পর দেওয়া এই ঘোষণা কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা ভুল উচ্চারণের সুযোগ রাখে না।
এছাড়াও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রামাণ্য গ্রন্থেও এই সংখ্যাটি সমর্থিত হয়েছে:
- এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা: ২০০৩ সালের সংস্করণে 'বাংলাদেশ' বিষয়ক অধ্যায়ে ১৯৭১ সালে নিহত মানুষের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
- পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী লেখিকা সামান্থা পাওয়ার: তার বিখ্যাত বই "A Problem from Hell": America and the Age of Genocide-এ ১৯৭১ সালের শহীদদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ বলা হয়েছে। এটি গণহত্যা বিষয়ক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।
- গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস: দ্য গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী, বাংলাদেশের গণহত্যা বিংশ শতাব্দীর সর্বোচ্চ পাঁচটি গণহত্যার একটি।
- লিও কুপার: এই প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক তার বই জেনোসাইড-এর প্রচ্ছদে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশির গণহত্যার শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
- ড. টেড রবার্ট গুর এবং ড. বারবারা হার্ফ: তাদের গবেষণালব্ধ বই "Towards Empirical Theory of Genocides and Politicides"-এ তারা ১৯৭১ সালের সংঘাতে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
এই আর্টিকেলের শুরুতেই আমরা যার কথা বলেছিলাম, সেই হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. রুডলফ জোসেফ রুমেল-এর গবেষণাও এই সংখ্যাকে সমর্থন করে। তার লেখা 'STATISTICS OF DEMOCIDE' বইটিকে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে অন্যতম ব্যাপক ও নির্ভরযোগ্য বই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বইয়ের অষ্টম অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বনিম্ন ৩ লক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। রুমেল তার 'China's Bloody Century' এবং 'Lethal Politics: Soviet Genocide and Mass Murder Since 1917' বইগুলোতে গণহত্যার পরিসংখ্যান নির্ণয়ের পদ্ধতি দিয়েছেন, যা আগ্রহীরা দেখতে পারেন। ড. টেড রবার্ট গুর, লিও কুপার এবং প্রফেসর রুমেল সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে ১৯৭১ সালে ১২ লক্ষ ৪৭ হাজার মানুষ কোথায় এবং কীভাবে মারা গেছেন। অর্থাৎ, মাত্র ১৮টি জেলার হিসাবেই মৃতের সংখ্যা ১২ লক্ষের বেশি। চিত্র ৪ দ্রষ্টব্য।
'DEATH BY GOVERNMENT' বইয়ে অধ্যাপক রুমেলের দেওয়া একটি সারণী (Table 13.1) থেকে এই হিসাব আরও স্পষ্ট হয়। সেখানে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ১,৭২৫,০০০ (সতের লক্ষ পঁচিশ হাজার)।
এই সারণীতে গণহত্যা (Democide) এবং যুদ্ধ/বিদ্রোহে (War/Rebellion) নিহতদের সংখ্যা আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে (চিত্র ৫ দ্রষ্টব্য)। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ১৫ লক্ষ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে অধিকাংশই অর্থাৎ ১৫ লক্ষই পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) নিহত হয়েছেন। এই হিসাবগুলো প্রমাণ করে যে, ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা কোনো মনগড়া বা ভুল অনুমান নয়, বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং নথিপত্রে বারবার উঠে আসা একটি বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান।
ঘাতকের নিজের স্বীকারোক্তি: মিথ্যাচার যখন ধোপে টেকে না
যারা ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেন, তাদের জন্য এটি একটি বড় প্রশ্ন যে, একজন ঘাতকের স্বীকারোক্তিকেও তারা কেন অস্বীকার করতে চান? আমাদের দেশের দোসররা যখন এই সংখ্যাকে ৩ লাখ বলে দাবি করে, তখন তাদের তথাকথিত যুক্তিগুলো কত দুর্বল হয়ে পড়ে, যখন আমরা খোদ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সত্যের মুখোমুখি হই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, যিনি একাত্তরের গণহত্যার মূল হোতাদের একজন, সেই জেনারেল নিয়াজী নিজেই এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে, পাক বাহিনী ১২ থেকে ১৫ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে (চিত্র ৬ দ্রষ্টব্য)।
!চিত্র ৬ঃ ঘাতক নিয়াজির স্বীকারোক্তি
এটি কোনো বিদেশি সাংবাদিকের অনুমান বা কোনো গবেষকের হিসাব নয়, বরং সরাসরি একজন প্রধান ঘাতকের নিজের মুখে দেওয়া তথ্য। স্বাভাবিকভাবেই, একজন খুনি তার অপরাধের মাত্রা কম করে বলতে চাইবে। তাই নিয়াজীর এই স্বীকারোক্তি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, প্রকৃত সংখ্যা ১৫ লক্ষের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এরপরও যারা ৩ লক্ষের বুলি আওড়ান, তাদের পাকিস্তানপ্রেম কতটা গভীর হলে এই ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যাচার করতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়।
শুধু নিয়াজী নয়, তৎকালীন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিচারণেও গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত ডায়েরিতেও এর প্রমাণ মেলে। ১১ নভেম্বর, ১৯৭১ সালের একটি ঘটনা বর্ণনা করে সেখানে লেখা হয়েছে, "একজন তরুণ অফিসার যাকে মানসিক চিকিৎসার জন্য সিএমএইচ রাওয়ালপিন্ডিতে আনা হয়েছে, সে প্রায় ১৪,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের নিছক চিন্তা তাকে খিঁচুনি এবং দুঃস্বপ্ন দেয়।" (চিত্র ৭ দ্রষ্টব্য)
ভাবা যায়! একজন সাধারণ সৈনিক একাই প্রায় ১৪,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে। এই সংখ্যাগুলো আমাদের কল্পনারও বাইরে। অথচ এদেশেরই পরাজিত শক্তির বংশধররা বধ্যভূমিতে মাথার খুলি গুণে শহীদদের সংখ্যা প্রমাণ করতে চায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কুযুক্তি দিয়ে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জঘন্য অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালে এরা কোথায় মুখ লুকানোর জায়গা পাবে?
এই আর্টিকেলটায় আমরা বারবার তথ্যের গভীরে গিয়েছি, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছি এবং আন্তর্জাতিক নথিপত্র ঘেঁটেছি। আমরা দেখেছি, কীভাবে ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি কোনো মনগড়া গল্প নয়, বরং এক কঠোর সত্য, যা গণকবরের নীরবতা, ঘাতকের স্বীকারোক্তি এবং বিশ্বখ্যাত গবেষকদের বিশ্লেষণে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু সব হিসাবের বাইরে, এই ৩০ লক্ষ সংখ্যাটির প্রতিটি অঙ্ক এক একটি জীবন, এক একটি স্বপ্ন, এক একটি পরিবারের গল্প। তারা ছিলেন আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী। তাদের বুকের তাজা রক্তে রাঙানো আমাদের এই সবুজ জমিন।
যারা আজও এই সংখ্যা নিয়ে রাজনীতি করে, তারা আসলে সেই শহীদের আত্মত্যাগকে অপমান করে। তারা আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু ইতিহাস মিথ্যাচারকে ক্ষমা করে না।