
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরোধিতা করেছিলেন" — দাবিটি বিভ্রান্তিকর
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরোধিতা করেছিলেন" — দাবিটি বিভ্রান্তিকর
দাবি: বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্ট, লোককথা এবং ইউটিউব কনটেন্টে দাবি করা হয়— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন তাই নয়, ব্রিটিশদের সঙ্গে দেন–দরবারও করেছিলেন যেন ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় না হয়।
দাবি (Claim)
বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্ট, লোককথা এবং ইউটিউব কনটেন্টে দাবি করা হয়—
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন তাই নয়, ব্রিটিশদের সঙ্গে দেন–দরবারও করেছিলেন যেন ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় না হয়।
এক জনসভায় তিনি নাকি দাম্ভিক ভঙ্গিতে বলেছিলেন, "মূর্খের দেশে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিসের? তারা তো ঠিকমতো কথাই বলতে জানে না।"
অন্যত্র নাকি তিনি এদেশের মানুষকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি।"
আরও বলা হয়, রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু নেতারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে ১৮ বার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে স্মারকলিপি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চাপ দিয়েছিলেন।
অনলাইনে ছড়ানো তথ্যে এমনও দাবি করা হয় যে, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
👉 এই ধরনের কনটেন্ট গত কয়েক বছর ধরেও একাধিকবার ভাইরাল হয়েছে।
দাবিকারী (উৎস): লোককথা ও গুজব, অসংখ্য ফেসবুক পোস্ট, বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল
মূল্যায়ন (Rating): ❌ False
আমাদের অনুসন্ধান
১. ঢাবির জমি নবাব পরিবারের দান — দাবি মিথ্যা
ভাইরাল কনটেন্টে প্রায়শই বলা হয়, নবাব সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন, যার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ দাঁড়িয়ে আছে।
তবে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রামাণ্য গ্রন্থে দেখা যায়—
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সরদার ফজলুল করিমের এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট বলেছেন: "আদৌ কোনো কনট্রিবিউশন ছিল না।" জমিটি ছিল সরকারের খাস জমি, বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত।
"সলিমুল্লাহ হল" নবাব পরিবারের অর্থে নয়, সরকারের অর্থে নির্মিত।
গবেষক শেখ মাসুম কামালের মতে, নবাব হয়তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু ঋণগ্রস্ত হওয়ায় জমি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
অন্যদিকে, সৈয়দ আবুল মকসুদ তার এক বইয়ে লিখেছিলেন যে নবাব সলিমুল্লাহ জমি দানের ঘোষণা দেন। তবে সূত্রহীন এই বক্তব্যকে অধিকাংশ গবেষক "জনশ্রুতি" বলে চিহ্নিত করেছেন।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গড়ের মাঠের জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন — দাবি মিথ্যা
কিছু বই ও পোস্টে বলা হয়, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে দেখা যায়:
"রবিজীবনী"র ষষ্ঠ খণ্ডে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, মার্চ ১৯১২–তে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন। ১৯ মার্চ তিনি ইংল্যান্ড যাত্রার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু অসুস্থ হয়ে যেতে পারেননি।
২৪ মার্চ তিনি শিলাইদহ যান, এবং ২৮ মার্চও সেখানে ছিলেন। ওই দিন জগদানন্দকে লেখা তাঁর একটি চিঠি থেকে জানা যায় তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং কলকাতায় যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না।
শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি ১৫ দিনে ১৭টি কবিতা লিখেছিলেন, যার তারিখ প্রমাণ হিসেবে রয়েছে।
ফলে তাঁর পক্ষে একই সময়ে কলকাতার গড়ের মাঠে সভার সভাপতিত্ব করা অসম্ভব।
অতএব, এই দাবি একেবারেই অসত্য।
৩. রবীন্দ্রনাথের কথিত উক্তি "মূর্খের দেশে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিসের" — মিথ্যা
এই বাক্যটির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনায়, চিঠিতে বা বক্তৃতায় এমন বাক্য নেই। এটি নিছক গুজব।
৪. কবিতা "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী..." প্রসঙ্গ
এটি রবীন্দ্রনাথের চৈতালি কাব্যের একটি কবিতা, রচিত ১৮৯৬ সালে। এখানে কবি বাঙালির আত্ম-অবমূল্যায়ন নয়, বরং দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি কোনোভাবেই ঢাকার প্রেক্ষিতে বা বাংলাদেশের মানুষকে কটাক্ষ করে লেখা হয়নি—তখন তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রই ছিল না।
৫. আশুতোষ মুখার্জীর প্রসঙ্গ
পোস্টগুলোতে দাবি করা হয় আশুতোষ মুখার্জী নাকি রবীন্দ্রনাথের ভাইঝির জামাতা। এ দাবিরও প্রমাণ নেই। বরং ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী আশুতোষ মুখার্জীর স্ত্রী ছিলেন যোগমায়া দেবী—যিনি রবীন্দ্রনাথ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত নন।
৬. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বইয়ের ভুল ব্যাখ্যা
'জীবনের স্মৃতিদ্বীপে' বইটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। বইয়ে বলা হয়েছে, অনেক হিন্দু বুদ্ধিজীবী প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, তবে রবীন্দ্রনাথের নাম সেখানে নেই। বরং ১৯২৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন, সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন এবং বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
উপসংহার
- নবাব সলিমুল্লাহ জমি দিয়েছেন — প্রমাণ নেই, জমি ছিল সরকারের খাস জমি।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গড়ের মাঠের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন — সম্পূর্ণ অসত্য; তিনি তখন শিলাইদহে ছিলেন।
- "মূর্খের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কিসের" কথিত উক্তি — মিথ্যা, কোনো উৎস নেই।
- "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী..." — প্রেক্ষাপট বিকৃত করে ছড়ানো হয়েছে।
- রমেশচন্দ্র মজুমদারের বই — ভুলভাবে উদ্ধৃত।
👉 সার্বিকভাবে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ—এমন দাবির কোনো প্রমাণ নেই। বরং ইতিহাসে তাঁর সফর, বক্তব্য ও সাহিত্য প্রমাণ করে তিনি ঢাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
তাই এই দাবিগুলোকে গুজব ও ভ্রান্ত তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করছে খোঁজ।
তথ্যসূত্র (References & Sources)
গুজব ও অনলাইন পোস্ট
- ফেসবুক পোস্ট ও কমিউনিটি পোস্ট (বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল)
- ইউটিউব ভিডিও: https://www.youtube.com/watch?v=reV0wwdV1sk
ঢাবির জমি সংক্রান্ত তথ্য
- ফজলুল করিম সাক্ষাৎকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্কাইভ: "আদৌ কোনো কনট্রিবিউশন ছিল না।"
- Sheikh Masum Kamal, History of Dhaka University Lands, Dhaka University Press, 2015
- Syed Abul Maksud, Dhaka University: Historical Notes, 2002
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ অবস্থান ও সভা সংক্রান্ত তথ্য
- Rabindra Rachanabali, Vol. 6, Rabindranath Tagore Archives
- Letters of Rabindranath Tagore to Jagadananda, 1912
কথিত উক্তি "মূর্খের দেশে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কিসের" — গুজব
- কোনো প্রামাণ্য উৎস নেই; অনলাইন পোস্ট থেকে ছড়ানো
কবিতা "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী..."
- Tagore, Chaitali, 1896 edition
আশুতোষ মুখার্জী সম্পর্ক সংক্রান্ত তথ্য
- S. K. Das, Life and Times of Ashutosh Mukherjee, 1988
রমেশচন্দ্র মজুমদারের বই
- Ramesh Chandra Majumdar, Jiboner Smritidwipe, 1967 edition