
একাত্তোরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের প্রহসন- ৩০ লক্ষ না, ৩ লক্ষও না মাত্র ২ হাজার?
একাত্তোরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের প্রহসন- ৩০ লক্ষ না, ৩ লক্ষও না মাত্র ২ হাজার?
দাবি: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বমোট মাত্র ~২,০০০ জন নিহত হয়েছেন
একাত্তোরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের প্রহসন- ৩০ লক্ষ না, ৩ লক্ষও না মাত্র ২ হাজার?
সারকথা
পিনাকী ভট্টাচার্যের ইন্টারনেটে প্রচারিত দাবিটি — "১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বমোট মাত্র ~২,০০০ জন নিহত হয়েছেন" — সম্পূর্ণ অশ্রদ্ধাজনক, বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণহীন ও ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি লঙ্ঘন করে। এই দাবি কেবলমাত্র ঔদ্ধত্য নয়; এটি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জীবন দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগকে অপমান করা। নিচে আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক দলিল, আন্তর্জাতিক গবেষণা, জনমিতিক (demographic) তথ্য এবং বহু-অঞ্চলের গণহত্যার উল্লেখযোগ্য ঘটনার উল্লিখিত প্রমাণ তুলে ধরে পিনাকীর এই মিথ্যাচারকে নিরুৎসাহিত করছি।
১) পিনাকীর দাবির সারমর্ম — কোথায় এই মিথ্যা এসেছে?
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য সম্প্রতি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা নিয়ে একটি অত্যন্ত বিতর্কিত এবং ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা দাবি করেছেন। তার এক্স (পূর্বতন টুইটার) পোস্টে তিনি দাবি করেছেন যে, আমেরিকান সাংবাদিক উইলিয়াম ড্রামন্ডের অনুসন্ধান অনুসারে যুদ্ধের পর পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা মৃতের সংখ্যা মাত্র ২,০০০, এবং আওয়ামী লীগ এই সংখ্যাকে ফুলিয়ে ৩০ লক্ষে পরিণত করেছে [১]।
পিনাকী ভট্টাচার্য তার পোস্টে উইলিয়াম ড্রামন্ডকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, যুদ্ধের পর বাংলাদেশে অনুসন্ধান করে তিনি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা মৃতের সংখ্যা মাত্র ২,০০০ পেয়েছেন। এই দাবি সম্পূর্ণভাবে বিকৃত এবং অর্ধসত্যের উপর ভিত্তি করে। উইলিয়াম ড্রামন্ড, যিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, তার রিপোর্টিংয়ে ৩০ লক্ষের সংখ্যাকে "অতিরঞ্জিত" বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তিনি কখনো ২,০০০-এর মতো নগণ্য সংখ্যা দাবি করেননি। বরং, এই সংখ্যাটি পাকিস্তানপন্থী লেখকদের দ্বারা প্রচারিত একটি মিথ, যা ড্রামন্ডের লেখাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে [২]। ড্রামন্ডের মূল লেখায় (যেমন লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে প্রকাশিত) তিনি গণহত্যার ভয়াবহতা স্বীকার করেছেন, কিন্তু সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন—কোনো ২,০০০-এর মতো হাস্যকর সংখ্যা নয়। পিনাকীর এই বিকৃত উদ্ধৃতি কেবল তার পাকিস্তানপ্রেমী মানসিকতার প্রকাশ, যা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের উপর একটি জঘন্য অপমান।
এছাড়া, পিনাকী শরণার্থীদের সংখ্যা নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রেম নাথ হুনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, প্রকৃত শরণার্থী ছিল মাত্র ৯০,০০০, যা ১ কোটিতে ফুলিয়ে তোলা হয়েছে। এই দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা। জেনারেল হুনের কোনো অফিসিয়াল বই বা সাক্ষাৎকারে এমন কোনো সংখ্যা উল্লেখ নেই। বরং, ইউএনএইচসিআর এবং ভারতীয় সরকারের রেকর্ড অনুসারে, ১৯৭১ সালে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত [৩]। পিনাকীর এই মিথ্যাচার কেবল তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে প্রকাশ করে, যা ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি ন্যারেটিভকে প্রমোট করে।
২) সরকারের ও আন্তর্জাতিক গবেষকদের নির্ণায়ক মন্তব্য — ৩ মিলিয়ন/৩০ লক্ষ কেবল গুজব নয়, সমর্থিত হিসাব আছে
বাংলাদেশের সরকারি প্রচলিত হিসাব—বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ১৯৭১ সালের শহীদ সংখ্যা ৩,০০০,০০০ (৩০ লাখ), এই সংখ্যাটি বাংলাদেশ সরকারের ঐতিহ্যগত ও সরকারি বর্ণনায় অন্তর্ভুক্ত আছে; বিভিন্ন সমীক্ষা ও পর্যালোচনায় সরকারি অনুমানটি আলোচিত হয়েছে [৪]।
আধুনিক পুনঃবিশ্লেষণ ও সমসাময়িক গবেষণাগুলো (পিয়ার-রিভিউড এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ) মনে করায় যে নিহতের ব্যাপকতার ব্যাপারে ধারাবাহিক প্রমাণ আছে; ১৯৭১-এর ঘটনাবলীর ওপর সামগ্রিক গবেষণাগুলো বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেও "২ হাজার" ধরণের সংখ্যাকে সমর্থন করার মতো কোন হিসাব বা উৎস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক লিটারেচারে নেই [৫]।
৩) জনমিতিক ও পরিসংখ্যানিক প্রমাণ — ১৯৭১ সালে মৃত্যুহারের অস্বাভাবিক স্পাইক
বিশ্বব্যাংকের Crude death rate-এর সময়সিরিজে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মৃতুহার একাধিক উৎসে (yearly crude death rate) নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এটি বৃহৎ মানের অতিরিক্ত মৃত্যুর স্পষ্ট ডেমোগ্রাফিক ইঙ্গিত। ঐ ডেটা সেটগুলো ১৯৭১-এ এক অস্বাভাবিক শিখর দেখায়, যা স্বাভাবিক পরিবর্ধন বা রোজকার বীমার ভুল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না [৬]।
সাম্প্রতিক গণিত/পরিসংখ্যান ভিত্তিক বিশ্লেষন (পিয়ার-রিভিউড), শরণার্থী শিবিরের মৃত্যুহার ও জনমিতিক শূন্যস্থান বিশ্লেষণগুলোও একই দিক নির্দেশ করে: বহু সহস্র/লক্ষ নম্বরের অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছিল—২৫–১০০ ইলেকট্রনিক/আর্কাইভ সূত্রে প্রকাশিত কাচা-ডেটা এই ধারনাকে সমর্থন করে [৩]।
৪) নৃশংস গণহত্যার প্রমাণ — একত্রে বহু 'শহীদভূমি' এবং গণকবরের দলিল
একেকটি পৃথক স্থানে সংঘটিত গণহত্যা-ঘটনার কেবল এক বা দুইটি উদাহরণই ২-৩ হাজারের ধারণাটিকে ভূল প্রমাণ করে:
চুকনগর (Chuknagar) — খালনার ডুমুরিয়া: স্থানীয় ও ঐতিহাসিক সূত্রে একাধিক রিপোর্টে এ মাসব্যাপী (২০ মে ১৯৭১) সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে ১০,০০০–১২,০০০ হতাহতের স্থানীয় অনুমান উল্লেখ আছে; স্থানীয় বৈশিষ্ট্য, অঙ্গভঙ্গি ও ভুক্তভোগী সাক্ষ্য এই সংখ্যাকে সমর্থন করে [৭]।
গল্লামারী (Gallamari) — বটিয়াঘাটা/বাটিয়াঘাটা: নির্দিষ্ট স্থানে কবর ও হত্যাকাণ্ডের স্মারক ও স্থানীয় তদন্তে প্রায় ১০–১৫ হাজার হতাহতের তথ্য পাওয়া গেছে [৮]।
জল্লাদখানা (Jalladkhana) — মিরপুর, ঢাকা: এখানে পাওয়া গণকবর ও ঘটনাচিত্র প্রমাণ করে যে ঢাকা শহরের অন্তত কয়েকটি স্থানে একক-একক গণহত্যা-সামষ্টির পরিসর হাজারহওয়া; ঐ স্মৃতিসৌধ ও মেমোরিয়াল ডাটাবেসে ঘটনাসমূহ নথিভুক্ত [৯]।
এই ধরনের একাধিক বিচ্ছিন্ন, কিন্তু সংঘবদ্ধ ঘটনা মিলিয়ে মোট পরিমাণ কখনোই ২ হাজারে আটকে থাকতে পারে না; কেরোসিন-রঙের কাগজে আঁকা "২ হাজার"-এর মত অতি-সংকীর্ণ সংখ্যা বাস্তব-দলিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে [৬][৭][৮][৯]।
৫) ঘাতকদের স্বীকারোক্তি, সামরিক নথি ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র — বিচ্ছিন্নতা নয়, বিস্তৃতি
জেনারেল নিয়াজী, যিনি গণহত্যার মূল হোতা, সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, পাক বাহিনী ১২ থেকে ১৫ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে। একজন খুনি তার অপরাধ কম করে বলতে চাইবে, তাই প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ডায়েরিতে উল্লেখ আছে যে, একজন তরুণ অফিসার একাই ১৪,০০০ মানুষ হত্যা করেছে, যা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছে। পিনাকীর ২,০০০-এর দাবি এই স্বীকারোক্তির সামনে একটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার, যা তার পাকিস্তানপ্রেমের গভীরতা প্রকাশ করে [১০][১১]।
১৯৭১ সালের সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সংবাদ (Time, New York Times, অন্যান্য বর্ণনামূলক খবরে)-এ তখনকার রিপোর্টিংয়ে ব্যাপক গণহত্যা, শরণার্থীর সংখ্যা ও দিকনির্দেশনার উল্লেখ আছে — এগুলো ঐতিহাসিক রেকর্ডিংয়ে পর্যালোচিত হয়েছে [১২]।
তথ্যগত মন্তব্য: যে উক্তি(গুলি) পিনাকী বা তাঁর সমর্থকরা "ঘাতকের স্বীকারোক্তি" হিসেবে দেখান (যেমন- নিয়াজীর উদ্ধৃত কিছু লাইন), সেগুলো প্রায়শই কাটা-ছাঁটা, অনুবাদ-ঐতিহ্যগত বা প্রসঙ্গবহুলভাবে উপস্থাপিত হয় — এবং সঠিক প্রসঙ্গ ও প্রকৃত উত্স যাচাই ছাড়া দাবি গঠন করা অনুচিত। তবু, তাতেও "মাত্র ২ হাজার" ধরণের সংখ্যা ব্যাখ্যা করা যায় না; এমন গদি-ঘোষ অপ্রমাণিত [৫]।
৬) কেন "২ হাজার" বলা হচ্ছে — সম্ভাব্য মনস্তাত্ত্বিক/রাজনৈতিক কারণ (তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা)
রেট্রো-রিভিশনিজম ও রাজনৈতিক প্রণোদনা: ১৯৭১-এর হত্যাকাণ্ড ও দায়ের পরিমাণকে নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেখানো কিছু ন্যারেটিভ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা ঐতিহাসিক চিত্র ক্ষুন্ন করার চেষ্টা হতে পারে।
ছোট একক-সোর্সকে সারাবিশ্ব হিসেবে পেশ করা: কখনো-কখনো একক অপ্রমাণিত "কাউন্ট" ইন্টারনেটে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সেটাই বড়-বড় মন্তব্যের ভিত্তি হয়ে ওঠে — কিন্তু এটি বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক যাচাই নয়।
পরিসংখ্যানগত অজ্ঞতা: জনমিতিক প্রমাণাবলির অর্থ না বোঝা বা সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা—সব মিলিয়ে '২ হাজার'-ধারণার ন্যায্যতা নষ্ট করে।
৭) উপসংহার
পিনাকী ভট্টাচার্যের দাবি যে ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা মাত্র ২,০০০, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি এবং শহীদদের উপর একটি জঘন্য অপমান। এটি পাকিস্তানপন্থী প্রোপাগান্ডার পুনরাবৃত্তি, যা আন্তর্জাতিক গবেষণা, ডেমোগ্রাফিক ডেটা এবং ঘাতকদের স্বীকারোক্তি দিয়ে খণ্ডিত হয়। পিনাকীর এই মিথ্যাচার তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে প্রকাশ করে, যা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইতিহাস মিথ্যাচারকে ক্ষমা করে না—পিনাকীর প্রহসনও করবে না।
রায়
মিথ্যা।
৮) রেফারেন্স
[১] https://x.com/PinakiTweetsBD/status/1957826641268195813?
[২] https://www.paradigmshift.com.pk/pakistan-bangladesh/
[৩] Adhikari K., Death toll among the Bangladeshi refugees of the 1971 war (PLOS/PMC — বিশ্লেষণী আর্টিকেল, ২০২৫)। https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC11970699/
[৪] https://www.congress.gov/bill/117th-congress/house-resolution/1430/text?
[৫] R. J. Rummel, Statistics of Democide / Death by Government (বিশ্ববিদ্যালয় মানের বিশ্লেষণ, গণহত্যা-পরিসংখ্যান)। https://www.hawaii.edu/powerkills/SOD.CHAP8.HTM
[৬] World Bank — Death rate, crude (per 1,000 people) — Bangladesh (time-series showing 1971 spike)। https://data.worldbank.org/indicator/SP.DYN.CDRT.IN?locations=BD&utm_source
[৭] Chuknagar massacre — বিস্তারিত রিপোর্ট ও ইতিহাস (The Daily Star; Chuknagar collateral) https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/chuknagar-forgotten-massacre-3899636
[৮] Gallamari / Gallamary mass-grave reportage (Daily Star) https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/gallamari-mass-grave-still-bearing-marks-butchery-3573701
[৯] Jalladkhana Killing Field (Mirpur) — mass-grave site and documentation। https://en.wikipedia.org/wiki/Jalladkhana_Killing_field
[১০] https://www.banglatribune.com/national/628053/জল্লাদ-নিয়াজীর-স্বীকারোক্তি
[১১] Jalil, A. (2015, March 7). Ayub's Diaries. The Daily Star. https://www.thedailystar.net/ayubs-diaries-43166
[১২] সমসাময়িক আন্তর্জাতিক খবর/আর্কাইভ রিপোর্ট (Time, National Archives, The New Yorker ইত্যাদি) — ১৯৭১-এর রিপোর্টিং ও বিশ্লেষণ। https://www.nationalarchives.gov.uk/education/resources/the-independence-of-bangladesh-in-1971/