
ছাত্রশিবিরের দাবি অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ কী ছিলো ইসলাম বিরোধী কোনো যুদ্ধ?
ছাত্রশিবিরের দাবি অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ কী ছিলো ইসলাম বিরোধী কোনো যুদ্ধ?
দাবি: জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি প্রকাশনা, ছাত্র সংবাদের ডিসেম্বর-২০২৪ সংখ্যায় 'যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি' শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, "সে সময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল"
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি প্রকাশনা, ছাত্র সংবাদের ডিসেম্বর-২০২৪ সংখ্যায় 'যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি' শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, "সে সময়ের অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল" [১]। যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনোভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধ কে ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের এই দাবির তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে দেখেছে আমাদের খোঁজ টিম।
আমাদের অনুসন্ধান—সংক্ষেপে
- রাষ্ট্রীয় ও যুদ্ধকালীন নথিপত্রে ধারাবাহিক ইসলামী উচ্চারণ আছে, যা প্রমাণ করে মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়নি।
- উলামা-মাশায়েখ ও কওমি মাদ্রাসা অঙ্গনের একটি অংশ প্রকাশ্যে বা নৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন; ভারতীয় ও পাকিস্তানি আলেমদের মধ্যেও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান দেখা যায়।
- কিছু ধর্মভিত্তিক দল ও ব্যক্তির বিরোধিতা থাকলেও সেটি পুরো ইসলামপন্থী সমাজ বা ইসলামের অবস্থান হিসেবে সার্বিকীকরণ করা চলে না।
বিস্তারিত
১) রাষ্ট্রীয়/যুদ্ধকালীন ঘোষণায় ইসলামী চেতনার উপস্থিতি
২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার থেকে ঘোষণার দিনই কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অধিবেশন শুরু হয়; বক্তৃতা ইসলামী শুভেচ্ছা দিয়ে আরম্ভ হয়ে "নাসরুন মিনাল্লাহি ওয়া ফাত্হুন ক্বারীব" উচ্চারণে শেষ হয়, যার অর্থ "আল্লাহর সাহায্য ও জয় নিকটবর্তী" [২]। এটি মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক বার্তায় ইসলামী বোধের সরাসরি উপস্থিতি দেখায়।
১৪ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের জনগণের উদ্দেশে প্রথম নির্দেশনামা "আল্লাহু আকবর" দিয়ে শুরু হয় এবং শেষে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত থাকে—যা ন্যায়, সম্মান ও শান্তির আকাঙ্খাকে আল্লাহর নির্দেশের সাথে যুক্ত করে। ইসলামবিরোধী কোনো ভাষ্য নয়, বরং ঈমান-নির্ভর ন্যায়যুদ্ধের ফ্রেম [৩]।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরের নির্দেশনায় খোদার ওপর ভরসা, শহীদদের গায়েবানা জানাজা, কুরআন পাঠ, এমনকি সামরিক শিবিরে অস্থায়ী মসজিদ ও ইমাম নিয়োগ—এসব ছিলো যুদ্ধ-মনোবল বৃদ্ধির অংশ। যুদ্ধের রণধ্বনি হিসেবেও "আল্লাহু আকবর" উচ্চারিত হয়েছে।
বিজয়ের পর রাষ্ট্রনায়কের বেতার ভাষণে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া ও তাওফিক কামনা—রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকাশ্য কৃতজ্ঞতা [৪]। ইসলামবিরোধী যুদ্ধ হলে এমন ভাষ্য অস্বাভাবিক হতো।
২) আলেমসমাজ ও মাদ্রাসা অঙ্গনের সমর্থন/সহানুভূতি
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল; বিপরীতে কিছু ধর্মভিত্তিক দল যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিলেও সেটি সর্বসম্মত ইসলামী অবস্থান নয়।
গবেষণাগ্রন্থের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, রাজনীতি-সচেতন আলেমদের মধ্যে ১২–১৪% মুক্তিযুদ্ধপন্থী এবং ১৬–১৮% বিরোধী—অর্থাৎ একপাক্ষিক নয়; কওমি মাদ্রাসার অরাজনৈতিক বড় অংশের সহানুভূতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে।
শীর্ষ আলেম মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী মুক্তিযুদ্ধকে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই বলেছেন—এটি ইসলামী ন্যায়বোধের ব্যাখ্যা [৫]।
যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে; ২৫ মার্চের পর বড় মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করার নজিরও আছে [৬]।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ভারত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে শোষিতের পক্ষে ন্যায়সংগ্রাম হিসেবে সমর্থন দেয়; দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও, শরণার্থী শিবির ও ত্রাণকাজে সক্রিয় থাকে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের শীর্ষ নেতা ঢাকায় এসে আলেমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা পান—যা আনুষ্ঠানিক কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি [৭]।
পাকিস্তানের বিশিষ্ট আলেম তাকি উসমানি নিজ গ্রন্থে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংলাদেশে আচরণকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন—এটিও ইসলামী মনোভাবের দিক থেকে ন্যায়-অন্যায়ের স্পষ্ট বোধকে প্রতিফলিত করে [৮]।
৩) "ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধ"—এই প্রোপাগান্ডা কেন ভুল ফ্রেম
যুদ্ধের ময়দানে ইসলামী অনুষঙ্গ (দোয়া, জানাজা, রণধ্বনি) ছিল বাস্তব চর্চা; রাষ্ট্রীয় ঘোষণাপত্রেও ন্যায়ের কথা কুরআনের আলোকে উচ্চারিত—এগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগ্রামের পরিচয় [৯]।
ইতিহাসে কেউ কেউ যুদ্ধবিরোধী ছিলেন—কিন্তু তা ধর্মীয় পরিচয়ের সমার্থক নয়; এমনকি অমুসলিম বিরোধীরাও ছিলেন। যেমন চাকমা সম্প্রদায়ের ৫০ তম রাজা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন [১০]। তাই কেবল কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির বিরোধিতা দেখে পুরো ইসলাম বা মুসলমান সমাজকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলা ভ্রান্ত সার্বিকীকরণ।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—ধর্মানুভূতিকে আঘাত করার কোনো ভাষ্য সেখানে নেই। এটি ইসলামী ন্যায়বোধের সাথেই সাযুজ্যপূর্ণ।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বিকৃত উপস্থাপনা
মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু মহলে ইসলামি প্রতীক, যেমন দাঁড়ি-টুপি পরা ব্যক্তিদের রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চিত্রায়ণ ঐতিহাসিকভাবে ভুল। তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধৃত রাজাকারদের বেশিরভাগের পরনে ইসলামি চিহ্ন ছিল না। এই ধরনের উপস্থাপনা ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানোর একটি প্রচেষ্টা, যা সত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মূল্যায়ন
ছাত্রশিবির-ঘনিষ্ঠ দাবিটি বলে যে "অনেক মুসলিম না বুঝে জড়িয়ে পড়েছিল"—কিন্তু নথি-নির্ভর প্রমাণ দেখায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সমর্থন ছিল সচেতন ন্যায়-অবস্থানের নিশ্চিহ্ন উদাহরণে ভরা: যুদ্ধক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার-অনুশীলন, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় কুরআনিক ভাষ্য, আলেমসমাজের সক্রিয় সমর্থন/সহমর্মিতা, প্রতিবেশী দেশের আলেমদের নৈতিক সহায়তা—সব মিলিয়ে ইসলামবিরোধী যুদ্ধ—এই ফ্রেম ইতিহাসসঙ্গত নয়।
রায় (ভার্ডিক্ট)
মিথ্যা — মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ ছিল না; বরং বহু ইসলামপন্থী ব্যক্তি-সমাজ, মাদ্রাসা ও আলেম ন্যায়সংগ্রাম হিসেবে এ যুদ্ধে সমর্থন দিয়েছেন এবং অংশ নিয়েছেন।
তথ্যসূত্র
[১] https://www.prothomalo.com/bangladesh/lj7dkxhahi
[২] কবির, মফিজুল্লাহ; হাফিজুর রহমান, হাসান (২০১০)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। খণ্ড ১ম। বাংলাদেশ: হাক্কানী পাবলিশার্স। পৃ. ১২১।
[৩] কবির, মফিজুল্লাহ; হাফিজুর রহমান, হাসান (২০১০)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। খণ্ড ৩য়। বাংলাদেশ: হাক্কানী পাবলিশার্স। পৃ. ১৬–১৮।
[৪] অবদানকারীগণউ. প. (2025, August 6). বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র. উইকিপিডিয়া. https://tinyurl.com/nk7s6z2n
[৫] আসলাম, আসিফ (১৬ মার্চ ২০১৮)। "বেশিরভাগ আলেম মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ছিলেন"। যুগান্তর। ২৯ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মে ২০২১।
[৬] মবনু, সৈয়দ (২০১৮)। দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি (২য় সংস্করণ)। ঢাকা: নগর। পৃ. ৯২–৯৪। আইএসবিএন ৯৮৪৭০১৪২০০০৫৪
[৭] শিবলি, শাকের হোসাইন (২০১৩)। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ভূমিকা। ঢাকা: আলেম মুক্তিযুদ্ধা প্রজন্ম। পৃ. ১০।
[৮] ভট্টাচার্য, পিনাকী (২০২১)। মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম। বাংলাবাজার, ঢাকা: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ৬৮।
[৯] জামিল, শাফায়াত (২০১৬)। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ। পৃ. ৮৪–৮৬। আইএসবিএন ৯৮৪৪৬৫১৪৪১।
[১০] Ali, Shaheen Sardar; Rehman, Javaid; Rehman, Professor of International Law and Head of Brunel Law School Javaid (২০০১)। Indigenous Peoples and Ethnic Minorities of Pakistan: Constitutional and Legal Perspectives